বাংলা আমার দেশ। অথচ বাস্তবতা আর জীবনের দায়ে, যদিও আমাকে আজ থাকতে হচ্ছে আমার দেশ থেকে অনেক অনেক দূরে। তবুও বাংলার ভালবাসায় ভরা ভালোলাগা গুলো আর বাংলার অনুপম সৌন্দর্যকে আজও আমি রেখেছি আমার হৃদয়ের অতল গভীরে। আমি যে ভালবাসি আমার বাংলাকে, তাইতো প্রাণভরে বাংলার গান শুনি, প্রাণখুলে হাসি এবং বেষ্টন করে রেখেছি হৃদয়ের শীতল অনুভূতি দিয়ে। আমি যেখানেই থাকিনা কেন, আমার হৃদয়েই রেখেছি আমার বাংলাকে।
প্রায়শই আমি গ্রামাঞ্চলের স্বপ্ন দেখি, পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যদয়ের শয়নকামরা দেখি, আরো দেখি শান্তিময় চন্দ্রপ্রভা। সেই সহজ-সরল আর মিষ্টিময় জীবনকে খুঁজে ফিরি কখনো কখনো। গাছের মৃদুমন্দ বাতাসের অনুসরণে সেই শান্তির নিঃশ্বাস, হাঁটু সমান উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘন সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে ঢেউয়ের মত বয়ে যাওয়া প্রবল বেগে বায়ুপ্রবাহের সেই বিস্ময়। কিংবা যতক্ষণ না পাহাড়ের গুটানো দৃশ্য ফুরিয়ে যায় দৃষ্টিতে এবং যতক্ষণ না দিনের বিস্তৃত আলো ফুরিয়ে যায় মনে। এই সবের কোনো কিছুই যেন ভুলিনি এখনো। আর তাইতো এই সুদূরে থেকেও এখনো যখনই যা দেখি সেটাকেই আমার বাংলার রূপের সাথে তুলনা করে দেখি।
এখানেও উজ্জল প্রভাত দেখি, বিশাল নভোনীল আকাশ দেখি, আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের উড়তে দেখি, সবুজ গাছপালা দেখি, গাছে গাছে পাখিদের গান শুনি, তারা ভরা আকাশ দেখি, পাহাড়-পর্বত দেখি, সবুজ-শ্যামল মাঠও দেখি, তবুও কেন যেন প্রাণটা ভরতে চায় না। এখানেও অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ে, এখানেও বিশাল আকাশে উজ্জল চাঁদ উঠে, এখানেও সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাই, সুন্দর সুন্দর সব জায়গায় ঘুরা হয়, রক্তিম সূর্যাস্তও হয়, তারপরও কেন জানি আমার দেশের মত সুন্দর মনেই হয়না কিংবা আমার বাংলার মত রূপ কোথাও যেন দেখতে পাইনা। তাই বুঝি, আমার দেশের প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার যে কি সুখ আর শান্তি লাগে, তা কবির ভাষায় তাঁর গানে, কবিতায় ও বিভিন্ন লেখনিতে নানাভাবে প্রকাশ করেছেন সকল কবিরা।
বিশাল আকাশে ফক-ফকে সাদা বলের মত চাঁদটাকে দেখলেই আমার সাহেব আনন্দে আমাকে ডেকে উঠে বলে- "দেখো দেখো, কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। তাড়াতাড়ি আসো, দেখে যাও।"
আমি দৌড়ে যাই এবং বারান্দায় গিয়ে অবাক হয়ে বলি- "কি ব্যাপার এত ডাকাডাকি করছো যে? ওমা! তাইতো, কি সুন্দর চাঁদ !!" বলেই আমিও আনন্দিত হয়ে উঠি।
তখন আমার সাহেব আমাকে বলে- "দেখছ, অনেক সুন্দর আর অনেক বড় চাঁদটা তাইনা?"
তখন আমি বলি- "হুম আসলেই খুব সুন্দর এবং অনেক বড়, কিন্তু তারপরও কেমন যেন দেশের মত লাগেনা। মনে হয় যেন, কিছুর একটা অভাব রয়েছে।"
আমার সাহেব তখন আমাকে বলে- "সেতো নিজেদের দেশ বলে কথা, পার্থক্য তো থাকবেই।"
তারপরও আমরা এখানে দেশের মতই চাঁদনী রাতটাকে উপভোগ করতে চেষ্টা করি, বারান্দায় বসে কিংবা বাড়ির সামনের রাস্তায় হেটে। ঠিক তখনই দেশের কথা খুব মনে করি, দেশের চাঁদনী রাতের অনেক গল্প করা হয় আমাদের দুজনার। গল্প করতে করতে একসময় দুজনেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠি- "এমনি চাঁদনী রাতে দেশে কত যে আনন্দিত হয়েছিলাম এবং সবাই মিলে কতইনা আনন্দ করেছিলাম।"
কখনো কখনো আমার ছেলেদের নিয়ে সপরিবারে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করে, দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে, রাত্রি হয়ে গেলে বেশ মজাই হয়। এবং আরো বেশি মজা হয়, যদি হয় চাঁদনী রাত কিংবা বৃষ্টির রাত। তখন চাঁদনী রাত হলে আমার ছেলেরা এতই খুশি হয় যে, গাড়ির মুন-রোফটা খুলে দিয়ে অবাক চোখে দেখবে চাঁদটাকে। আমি এবং আমার সাহেব তখন ছেলেদের, দেশের অনেক গল্প শুনাই। ওরাও খুবই মনোযোগ দিয়ে দেশের গল্প শুনবে এবং আনন্দে বলে উঠবে- "আমরাও বাংলাদেশে যেতে চাই, ওখানে গিয়ে চাঁদনী রাত দেখব, বৃষ্টি দেখব, অনেক মজা করব, ইত্যাদি ইত্যাদি।"
ছুটির দিনে অঝোরে বৃষ্টি হলে আমার সাহেবের সেকি আনন্দ!! আমাকেও ডেকে নিয়ে যাবে বারান্দায় কিংবা জানালা খুলে দিয়ে বৃষ্টি দেখবে, আর দেশের বৃষ্টির দিনের অতীত স্মৃতিগুলো রোমন্হন করবে। তখনও দেশের কথা মনে করে বৃষ্টিটাকে খুব উপভোগ করতে চেষ্টা করি এবং এক সময় আনমনা হয়ে দুজনেই বলে উঠি- "এমন বৃষ্টির দিনে, কি মজাই না করেছি দেশে!!"
আমরা যারা দেশ থেকে অনেক দূরে থাকি, এমনি করে কতভাবে প্রতিটা মুহূর্তে দেশকে আমরা স্মরণ করে থাকি। সুখে-দুঃখে প্রতিটা ক্ষণেই যা কিছুই করি, যা কিছুই দেখি, সবকিছুতেই দেশের অনুভূতিটাকে স্মরণ করি এই জন্যই যে, অন্তরের শূন্যতাটাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও যদি বিলীন করতে পারি।
আর এমনটি হবেই বা না কেন? সেই ছোটবেলা থেকে এই বড়টি হয়েও দেখে এসেছি এবং এখনো মনের মধ্যে পুষে রেখেছি, বর্ণিল স্বপ্নে ভরা বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিযে মুগ্ধ করা মাধুর্য ঘিরে আছে সেখানে! ষড়ঋতুর সেই দেশে প্রকৃতি যে এত দ্রুত রং বদলাতে পারে তা কখনো দেখিনি পৃথিবীর অন্য কোথাও। যে দিকে চোখ যেত, সেইদিকেই দেখতে পেতাম- সবুজ শ্যামল মাঠ, সোনালি ফসলে ভরা পাকা শস্যের ক্ষেত, ফুলে-ফলে ভরা গাছপালা, তৃণ গুল্ম শোভিত বন-বনানী, সে এক প্রকৃতির চোখ জুড়ানো মনোরম দৃশ্য। নদীমাতৃক এই দেশের বর্ষার বৃষ্টিপাতে কানায় কানায় ভরে যাওয়া নদনদী, বয়ে যাওয়া গতিশীল নদীস্রোত, আর সমুদ্র সৈকতের সমুদ্র দৃশ্য, যেন আমরা আকণ্ঠ ডুবে আছি এই সৌন্দর্য্যসাগরে এবং পান করছি যেন তাঁরই রূপসুধা। চাঁদের আলোয় রাতের বাঁশঝাড় ও গাছপালা গুলো যেন প্রকৃতির আরেক রূপ। স্বপ্নঘেরা পাহাড়-পর্বত, জলপ্রপাত আর বনভূমি, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছগুলো, মনে হয় যেন অনন্ত প্রহরীর মত অপেক্ষা করছে, পথিকদের স্বাগত জানাতে। তাই নির্দ্বিধায় এই আমি বলতে পারি যে, আমার দেশ শুধুই সুন্দর নয়, সে এক অপূর্ব, সে এক অতূলনীয়, এবং কি যে অসাধারণ সুন্দর সেই বাংলা আমার। আর তাইতো আমার হৃদয়ের অতল গভীরে বহু যত্ন করে রেখেছি আমার প্রাণপ্রিয় সেই বাংলার রূপটাকে।